ইতিহাস কি বলে মাহুতটুলি নামকরনে
ইতিহাস কি বলে মাহুতটুলি নামকরনে
ঢাকা শহরের পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী ও পরিচিত এলাকা হলো মাহুতটুলি। এই এলাকার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকার ইতিহাস, নবাবি আমল এবং এক বিশেষ পেশাজীবী শ্রেণির স্মৃতি। মাহুতটুলি শুধু একটি এলাকার নাম নয়; এটি ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
মাহুতটুলি কোথায় অবস্থিত?
মাহুতটুলি পুরান ঢাকার একটি প্রাচীন মহল্লা। এটি সদরঘাট, সূত্রাপুর, আরমানিটোলা ও গেন্ডারিয়া এলাকার কাছাকাছি অবস্থিত। ব্রিটিশ শাসনামলের আগেও এই এলাকা ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পরিচিত ছিল।
“মাহুত” শব্দের অর্থ
মাহুতটুলি নামটি মূলত দুটি শব্দ থেকে এসেছে—
- মাহুত
- টুলি
মাহুত শব্দের অর্থ হলো—হাতির পরিচর্যাকারী বা হাতি চালক। যারা রাজা-বাদশাহ, নবাব কিংবা ধনী ব্যক্তিদের হাতির দেখভাল করতেন, তাদের বলা হতো মাহুত।
টুলি শব্দটি ফারসি ও বাংলায় সাধারণত বসতি, পাড়া বা মহল্লা বোঝাতে ব্যবহৃত হতো।
অর্থাৎ, মাহুতটুলি মানে মাহুতদের বসবাসের এলাকা বা পাড়া।
নবাবি আমলে হাতি ও মাহুতের গুরুত্ব
মোগল ও নবাবি আমলে হাতি ছিল রাজকীয় বাহনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। নবাবদের প্রাসাদ, সেনাবাহিনী, রাজকীয় শোভাযাত্রা ও যুদ্ধের কাজে হাতি ব্যবহৃত হতো। ঢাকায় তখন অসংখ্য হাতি ছিল, আর সেই হাতিগুলোর দেখভালের জন্য প্রয়োজন হতো দক্ষ মাহুত।
এই মাহুতরা সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তারা রাজদরবারের সঙ্গে যুক্ত থাকায় বিশেষ মর্যাদা পেতেন। তাদের থাকার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ করা হতো, যেখানে হাতির রাখাল, খাদ্য সংরক্ষণ এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল।
মাহুতদের বসতি থেকেই “মাহুতটুলি”
ইতিহাসবিদদের মতে, ঢাকার নবাবি আমলে এই এলাকায় বহু মাহুত বসবাস করতেন। এখানেই হাতির আস্তাবল, মাহুতদের ঘরবাড়ি এবং হাতির খাবার সংরক্ষণের স্থান ছিল।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এই এলাকাকে “মাহুতদের টুলি” বা “মাহুতটুলি” নামে ডাকতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এটি এলাকার স্থায়ী নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্রিটিশ আমলে মাহুতটুলির পরিচিতি
ব্রিটিশ শাসনামলেও মাহুতটুলির নাম বহাল থাকে। যদিও তখন হাতির ব্যবহার কমে আসছিল, তবুও ঐতিহাসিক নাম পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন মানচিত্র ও নথিপত্রে মাহুতটুলির নাম পাওয়া যায়।
এই সময় মাহুতটুলি একটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকার রূপ নিতে শুরু করে। পুরান ঢাকার অন্যান্য এলাকার মতো এখানেও ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটে।
পুরান ঢাকার নামকরণের ধারার সঙ্গে মাহুতটুলি
পুরান ঢাকার অনেক এলাকার নামই কোনো পেশা, সম্প্রদায় বা ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। যেমন—
- কামারটুলি (কামারদের বসতি)
- তাঁতীবাজার (তাঁতিদের বাজার)
- শাঁখারীবাজার (শাঁখারিদের এলাকা)
এই ধারাবাহিকতায় মাহুতটুলিও একটি পেশাভিত্তিক নামকরণ, যা ঢাকার সামাজিক ইতিহাসের পরিচায়ক।
মাহুতটুলির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
মাহুতটুলি শুধু নামেই নয়, সামাজিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করতেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা কেন্দ্র এবং ব্যবসায়িক স্থাপনাও গড়ে ওঠে।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা—সংকীর্ণ গলি, পুরোনো দালান, ঐতিহাসিক মসজিদ ও মন্দির—মাহুতটুলিতেও দেখা যায়।
আধুনিক সময়েও ঐতিহাসিক নাম অটুট
বর্তমানে মাহুতটুলিতে আর হাতি বা মাহুত নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এলাকা আধুনিক হয়েছে। কিন্তু নামটি আজও বহাল আছে, যা অতীতের স্মৃতি বহন করে।
এই নাম আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
- ঢাকার নবাবি ইতিহাস
- পেশাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা
- পুরান ঢাকার ঐতিহ্য
ইতিহাস সংরক্ষণের গুরুত্ব
মাহুতটুলির মতো নামগুলো আমাদের ইতিহাস জানার একটি জানালা। যদি এই নামগুলোর পেছনের গল্প সংরক্ষণ না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের শিকড় সম্পর্কে জানবে না।
এ ধরনের ঐতিহাসিক নামকরণ গবেষণা ও সংরক্ষণ করা আমাদের সাংস্কৃতিক দায়িত্ব।
উপসংহার
মাহুতটুলি নামকরণের ইতিহাস মূলত ঢাকার নবাবি আমল ও মাহুতদের জীবনযাপনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। মাহুতদের বসবাস থেকেই এই এলাকার নামের উৎপত্তি। আজ হাতি নেই, মাহুত নেই, কিন্তু নামটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে।
মাহুতটুলি আমাদের শেখায়—একটি নাম শুধু নাম নয়, এটি একটি সময়, একটি সমাজ এবং একটি ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি।
ধানমন্ডি নামের নাম করনের ইতিহাস
ইতিহাস কি বলে মাহুতটুলি নামকরনে ইতিহাস কি বলে মাহুতটুলি নামকরনে ইতিহাস কি বলে মাহুতটুলি নামকরনে ইতিহাস কি বলে মাহুতটুলি নামকরনে ইতিহাস কি বলে মাহুতটুলি নামকরনে

