মিসকিন থেকে বিশ্বনেতা ভাসানীর অবিশ্বাস্য মুহূর্ত
মিসকিন থেকে বিশ্বনেতা ভাসানীর অবিশ্বাস্য মুহূর্ত
চীন সফর শেষে পাকিস্তানে ফেরার পথে বিমান নামল করাচিতে। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সেখানে সমবেত হয়েছিলেন এক বিশেষ অতিথিকে স্বাগত জানাতে—মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। পাকিস্তানের তৎকালীন মেয়র তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন এই কিংবদন্তি নেতাকে দেখার জন্য।
কিন্তু ভাসানী যখন মঞ্চে উঠলেন, তখন দর্শক-শ্রোতাদের মুখে ছড়িয়ে পড়ল নীরব গুঞ্জন। মাথায় তালের টুপী, পরনে সাধারণ লুঙ্গি—দেখতে যেন একদমই সাধারণ গ্রামের মানুষ। কোনো বিলাসিতার ছোঁয়া নেই, কোনো প্রভাবশালী নেতার চটকদার পোশাক নেই, নেই নিরাপত্তা বা অহংকারের কোনো চিহ্ন। পাকিস্তানি দর্শকদের কাছে এ অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। তাই তাদের মধ্যে একজন ফিসফিস করে বলতে শোনা গেল—
“ইয়ে তো মিসকিন হ্যায়।”
অর্থাৎ—“এ তো বড়ই সাধারণ মানুষ!”
হ্যাঁ, মাওলানা ভাসানীর সরলতা ছিল তাঁর পরিচয়ের অন্যতম শক্তি। সাধারণের মতো বাঁচতেন, সাধারণের সঙ্গেই সময় কাটাতেন, আর মজলুম মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন আপসহীন।
ধর্মচেতনার পরিচয়
মঞ্চে উঠে ভাসানী তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে। তাঁর তেলাওয়াতের স্বর, ভঙ্গি এবং গভীরতা মুহূর্তেই সেখানে উপস্থিত সবার মনোযোগ কেড়ে নিল। যারা একটু আগেই তাঁকে ‘মিসকিন’ বলেছিল, তারা আবার বললেন—
“ইয়ে তো মাওলানা হ্যায়।”
হ্যাঁ, তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই মাওলানা—ধর্মজ্ঞ, আধ্যাত্মিক, নিবেদিত একজন সত্যিকারের আলেম। তাঁর জীবনের অনেকটা সময়ই কেটেছে ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও মানবকল্যাণের কাজে। তাঁর চরিত্র ছিল নির্মল, তাঁর জীবন ছিল দ্বীন ও ন্যায়ের পথে প্রতিষ্ঠিত।
রাজনীতিতে ভাসানীর স্বর
ধর্মীয় বক্তব্য শেষ করে ভাসানী যখন রাজনৈতিক বক্তব্য শুরু করলেন, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া আরও বদলে গেল। তাঁর বক্তব্যে যুক্তি, সাহস, সময়ের বিশ্লেষণ, উপমহাদেশের রাজনীতির অভিজ্ঞতা—সব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত রাজনৈতিক পাঠ। পাকিস্তানি শ্রোতারা এবার অবাক হয়ে বললেন—
“আরে বাহ্! ইয়ে তো পলিটিশিয়ান হ্যায়।”
হ্যাঁ, তিনি শুধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না—ছিলেন জননেতা। সাধারণ মানুষের নেতা। তিনি কৃষক, শ্রমিক, নিপীড়িত মানুষের ভাষা বলতেন। পশ্চিম পাকিস্তান, চীন, ভারত, আরব বিশ্ব—সব জায়গায় তাঁর বক্তব্যে পাওয়া যেত সংগ্রামের ভাষা, মানবতার ভাষা।
বিশ্ব রাজনীতির বিশ্লেষক
ভাসানী যখন তার বক্তব্যের শেষ দিকে চলে এলেন, তখন তিনি বিশ্বশক্তির রাজনীতি, দমন-পীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতার ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, তাঁর শব্দে ছিল স্পষ্টতা এবং তাঁর বক্তব্যে ছিল গভীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।
এই পর্যায়ে সে দর্শকরাই আবার আওয়াজ তুললেন—
“হায় আল্লাহ, ইয়ে তো এস্টেটসম্যান হ্যায়!”
হ্যাঁ, তিনি ছিলেন এক বিশ্বমানের রাষ্ট্রনায়ক। উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম, নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা—এসব বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুস্পষ্ট ও আন্তর্জাতিক মানের। তাঁর অবস্থান ছিল সাহসী ও আপসহীন।
কেন ভাসানী ছিলেন অনন্য?
মাওলানা ভাসানী শুধু একজন নেতা নন; তিনি ছিলেন একটি যুগের প্রতীক। তাঁকে ‘মজলুম জননেতা’ বলা হয় কারণ তিনি সারা জীবন জুলুমের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
- তিনি ছিলেন কৃষক-শ্রমিকের অভিভাবক।
- তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার অধিকার আন্দোলনের রাজনৈতিক দিকনির্দেশক।
- তিনি ছিলেন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানবতাবাদী একজন আলেম।
- তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের মতো পোশাক পরা, সাধারণের মতো জীবনযাপন করা এক সত্যিকারের গণমানুষের নেতা।
তাঁর চরিত্র চিরদিন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে—
সাহসী মানুষের মতো কথা বলা,
সরল মানুষের মতো বেঁচে থাকা,
আর ন্যায়ের পক্ষে আপসহীন লড়াই করে যাওয়া।
উপসংহার
পাকিস্তানের সেই সংবর্ধনার দৃশ্য শুধু একটি ঘটনা নয়—এটি মাওলানা ভাসানীর বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের প্রতীক।
একই মানুষের মাঝে—
- দেখা গেল একজন সাধারণ মিসকিন,
- একজন ধর্মজ্ঞানী মাওলানা,
- একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক,
- এবং একজন আন্তর্জাতিক মানের রাষ্ট্রনায়ক।
তিনি ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন, যাঁদের উপস্থিতিতেই মানুষ উপলব্ধি করে—
নেতৃত্ব জন্মায় চরিত্র থেকে,
চেহারা থেকে নয়;
আত্মশুদ্ধি থেকে,
অহংকার থেকে নয়।
মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী তাই ইতিহাসে অমর—মানুষের জন্য তাঁর অবদান, সরলতা, সংগ্রাম এবং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান তাঁকে সময়ের সীমানা পেরিয়ে আরও বৃহৎ করে তুলেছে।
মিসকিন থেকে বিশ্বনেতা ভাসানীর অবিশ্বাস্য মুহূর্ত মিসকিন থেকে বিশ্বনেতা ভাসানীর অবিশ্বাস্য মুহূর্ত মিসকিন থেকে বিশ্বনেতা ভাসানীর অবিশ্বাস্য মুহূর্ত মিসকিন থেকে বিশ্বনেতা ভাসানীর অবিশ্বাস্য মুহূর্ত

