News

জিগাতলা নামকরণের ইতিহাস

জিগাতলা নামকরণের ইতিহাস

জিগাতলা নামের উৎপত্তি নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত ব্যাখ্যা হলো—“জিগা” নামের একটি বুনো গাছ এবং “টোলা” বা ছোট বসতির সম্মিলন থেকে “জিগা–টোলা”, যা ধীরে ধীরে উচ্চারণগত পরিবর্তনে “জিগাটোলা”—শেষ পর্যন্ত “জিগাতলা”-তে রূপ নেয়। কিন্তু এই নামের গভীরে রয়েছে ঢাকা শহরের জনবসতি–পরিবর্তন, মুগল প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস, নাগরিক কাঠামোর পতন–উত্থান এবং নগর–সংস্কৃতির দীর্ঘ যাত্রাপথ।


১. সুবা বাংলার রাজধানী বদল ও ঢাকার অবনতি

মুগল সাম্রাজ্যের সুবাদার মুর্শিদ কুলি খাঁ যখন রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করলেন, তখন ঢাকার সামাজিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব দ্রুত কমে আসে।

  • কর আদায় ও শাসনব্যবস্থার কেন্দ্র সরে যায়।
  • বহু পেশাজীবী—পারসিয়ান, তুর্কি, আফগান বংশোদ্ভূত কর্মকর্তা–কারিগর শহর ত্যাগ করেন।
  • বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র সরে গিয়ে নদী–নির্ভর অর্থনীতি ধসে পড়ে।

ফলে যে ঢাকা আগে নওয়াবি আমলের ব্যস্ত জনবহুল নগরী ছিল, তা পরিণত হয় ধীরে ধীরে অর্ধ–পরিত্যক্ত এক গঞ্জে।


২. শহর পরিত্যক্ত হলে কী ঘটে?—ধানমণ্ডি ও জিগাটলার জন্ম

মানুষ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নগর জায়গাজমি দখল করতে শুরু করে প্রকৃতি।

  • খালি বাড়িঘর ভেঙে পড়ে।
  • সড়কপথে আগাছা জন্মায়।
  • চারপাশে বুনো লতাগুল্মের জঙ্গল গড়ে ওঠে।

বর্তমানের অভিজাত ধানমণ্ডি, জিগাতলা, রায়েরবাজার, হাজারিবাগ—এসব এলাকা তখন ছিল নদী–উপকূলীয় নিম্নভূমি, জলাভূমি এবং বুনো গাছপালার অরণ্য।

এসময় ধানমণ্ডি এলাকায় বিশেষভাবে জিগা নামে একটি গাছের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ধারণা করা হয়, এটি হয়তো কোনো বুনো ফলগাছ বা লতাগাছ ছিল, যা জলাভূমি–সমৃদ্ধ অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ গাছের কারণে এলাকাটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত হতে থাকে “জিগার জঙ্গল” নামে।


৩. জঙ্গলের মধ্যে নতুন মানববসতির সূচনা—‘টোলা’ ধারণা

ঢাকার কেন্দ্র এলাকায় অবনতি হলেও, কিছু বণিক, মজুর, জেলে ও কৃষিজীবী মানুষ নতুন আশ্রয়ের খোঁজে এই জঙ্গলে এসে থিতু হতে শুরু করেন।
তারা—

  • জঙ্গল পরিষ্কার করতেন,
  • ছোট ছোট কুঁড়েঘর বা মাটির ঘর তৈরি করতেন,
  • এবং সেইসব ক্ষুদ্র বসতির নাম রাখতেন “টোলা”, অর্থাৎ ছোট গ্রাম কিংবা পাড়া।

উদাহরণ:

  • লালবাগ টোলা
  • নবাবগঞ্জ টোলা
  • রায়েরবাজার টোলা
  • এবং অবশ্যই জিগা গাছের নিচে গড়ে ওঠা টোলা—জিগা টোলা

সময়ের সাথে ভাষাগত সহজতার জন্য “জিগা টোলা” বলতেই লোকেরা স্বাভাবিকভাবে “জিগাটোলা” বলতে শুরু করে।


৪. উচ্চারণগত রূপান্তর: জিগাটোলা → জিগাতলা

ঢাকার আঞ্চলিক উপভাষায় ‘ওলা’ বা ‘উলা’ ধ্বনিগুলো প্রায়ই ‘লা’–তে রূপ নেয়। যেমন—

  • কাগজের “টেপা” → “টেপলা”
  • ‘চকোলা–টোলা’ → ‘চকলাতলা’

এই সাধারণ ধ্বনিগত পরিবর্তন থেকেই
জিগাটোলা → জিগাতলা
বিকাশ লাভ করে। আজও দুইভাবে উচ্চারণ করা হয়, তবে “জিগাতলা” ক্রমে সরকারিভাবে স্থায়ী নাম হয়ে গেছে।


৫. নদী, খাল আর ভৌগোলিক প্রভাব

জিগাতলা ছিল বুড়িগঙ্গার শাখা–প্রবাহ ও বিভিন্ন খালের সংযোগস্থলের কাছে।

  • এখানে বন্যা হত প্রচুর।
  • বর্ষাকালে এলাকা প্রায় ডুবে যেত।
  • নৌকায় চলাচল ছিল প্রধান মাধ্যম।

এই জলাভূমি–জঙ্গলভূমিই জিগা গাছের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেছিল।


৬. ব্রিটিশ আমলে জিগাতলার রূপান্তর

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ঢাকায় যখন ব্রিটিশরা প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্থাপন শুরু করলেন, তখন তারা নগর সম্প্রসারণের পরিকল্পনা হাতে নেন।

  • ব্রিটিশ সড়কগুলো শহরের পশ্চিমাঞ্চল ছুঁয়ে যায়।
  • বুড়িগঙ্গার তীরে কাস্টমস, গুদাম, নৌ–বন্দর গড়ে ওঠে।
  • এর ফলে জিগাতলার দিকে জনবসতি আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এসময় থেকেই জিগাতলা ধীরে ধীরে নগর–পরিবেশে ঢুকে পড়ে।


৭. পাকিস্তান আমল ও আধুনিক নগরায়ন

১৯৫০–৬০ দশকে সরকার যখন ধানমণ্ডিকে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা বানায়, তখন জিগাতলা হয়ে ওঠে সেই এলাকার প্রাকৃতিক সম্প্রসারণ।

  • ধানমণ্ডি লেকের উন্নয়ন
  • সড়ক সংযোগ
  • স্কুল–কলেজ প্রতিষ্ঠা (যেমন: জিগাতলা উচ্চ বিদ্যালয়)
  • নতুন আবাসিক প্লট

এসব পরিবর্তন জিগাতলাকে শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে পরিণত করে।


৮. বর্তমান জিগাতলা: বাণিজ্য–সংস্কৃতি–নগরজীবন

আজকের জিগাতলা—

  • বাণিজ্য কেন্দ্র
  • পোশাক ও শপিং মার্কেট (জিগাতলা বাস স্ট্যান্ড এলাকা)
  • আবাসিক এলাকা
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
  • সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র

ধানমণ্ডি লেক ও আশপাশের এলাকাকে কেন্দ্র করে জিগাতলার জনঘনত্ব ও নগরচাপ বেড়েছে বহুগুণ।


৯. নামের ভৌগোলিক–সামাজিক গুরুত্ব

জিগাতলার নাম শুধু একটি উচ্চারণগত গল্প নয়। এটি—

  • ঢাকার জনসংখ্যা–পরিবর্তনের ইতিহাস
  • নগর বিস্তারের ধারাবাহিকতা
  • সমাজ–অর্থনীতির ওঠানামা
  • স্থানীয় মানুষের সংস্কৃতি
  • এবং বন–জঙ্গল থেকে আধুনিক শহরে রূপান্তরের সাক্ষ্য

এক অর্থে জিগাতলা হলো সেই পুরনো ঢাকা–বহির্ভাগের গল্প, যা আজ শহরের অন্তঃকেন্দ্রে উঠে এসেছে।


১০. উপসংহার

জিগাতলা নামের উৎস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
নগর কখনো স্থির নয়; মানুষের আগমন–প্রস্থান, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন, অর্থনীতির উত্থান–পতন, প্রকৃতির প্রভাব—এসব মিলেই একটি জায়গার পরিচয় সৃষ্টি হয়। জিগাতলা হলো সেই দীর্ঘ যাত্রার সামগ্রিক ফলাফল—এক সময়ের জঙ্গল, এক সময়ের টোলা, আজকের আধুনিক নগরকেন্দ্র।

জিগাতলা নামকরণের ইতিহাস জিগাতলা নামকরণের ইতিহাস

জিগাতলা নামকরণের ইতিহাস জিগাতলা নামকরণের ইতিহাস জিগাতলা নামকরণের ইতিহাস জিগাতলা নামকরণের ইতিহাস জিগাতলা নামকরণের ইতিহাস জিগাতলা নামকরণের ইতিহাস

ইন্দিরা রোড নামকরণের ইতিহাস

ডিস্টিলারি রোড নামকরণের ইতিহাস

খিলগাঁও নামকরণের ইতিহাস

মিরপুর নামকরণের ইতিহাস

বংশাল নামকরণের ইতিহাস

ওয়ারী নামকরণের ইতিহাস

ফার্মগেট নামকরণের ইতিহাস

ফরাশগঞ্জ নামকরণের ইতিহাস

চকবাজার নামকরণের ইতিহাস

ইস্কাটন নামকরণের ইতিহাস

কারওয়ান বাজার নামকরণের ইতিহাস

পরীবাগ নামকরণের ইতিহাস

আজিমপুর নামকরণের ইতিহাস

গোপীবাগ নামকরণের ইতিহাস

ভূতের গলি নামকরণের ইতিহাস

শ্যামলী নামকরণের ইতিহাস

রমনা নামকরণের ইতিহাস

পিলখানা নামকরণের ইতিহাস

গেন্ডারিয়া নামকরণের ইতিহাস

মোহাম্মদপুর নামকরণের ইতিহাস

মগবাজার নামকরণের ইতিহাস

ধানমন্ডি নামের নাম করনের ইতিহাস

ইংলিশ রোড ও ফ্রেঞ্চ রোড নামকরণের ইতিহাস

মাহুতটুলি নামকরণের ইতিহাস

হাতিরঝিল নামকরণের ইতিহাস

এলিফ্যান্ট রোডের নামকরণের ইতিহাস

মালিবাগ নামকরণের ইতিহাস

জয়নাগ রোড নামকরণের ইতিহাস

সময়ের সংলাপের ফেইসবুক গ্রুপ

সময়ের সংলাপের ফেইসবুক পেইজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *